আরাকান রাজসভার পৃষ্ঠপােষকতায় মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের যে বিকাশ সাধিত হয়েছিল তা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
আরাকান রাজসভায় যে কয়েকজন কবি স্থান পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন আলাওল। তিনি সতের শতকের কবি।
তার রচিত একাধিক গ্রন্থ রয়েছে। তবে তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হলাে পদ্মাবতী’ । হিন্দি কবি মালিক মুহম্মদ জায়সির ‘পদুমাবৎ কাব্যের অনুবাদ ‘পদ্মাবতী’। অনুবাদ হলেও কবি এখানে অনেক মৌলিকতা দেখিয়েছেন।
জায়সি ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে ‘পদুমাবৎ রচনা করেন আর আলাওল আরাকান মন্ত্রী মাগন ঠাকুরের আদেশে ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে ‘পদ্মাবতী’ রচনা করেন।
‘পদ্মাবতী’তে বাস্তবতা ও কাল্পনিকতার চমৎকার মিশেল আছে। লােকসাহিত্যের মটিফ হিসেবে হীরামণি বা শুকপাখির অবতারণা। এই শুকপাখি অবশ্য সুফিবাদের প্রভাবজাত। পাখিত্ব ছাড়া এর আর সবই মনুষ্য চরিত্রের মতাে। পদ্মাবতীর রূপবর্ণনা অংশ আন্তরিক এবং কবির দূরদৃষ্টির পরিচায়ক।
রত্নসেন- পদ্মাবতীর বিয়ের অনুষ্ঠান সামাজিকতায় পরিপূর্ণ। উভয়ের দেহমিলন স্কুল হতে পারে, কিন্তু বর্ণনা বাস্তব, কাল্পনিক নয়। অতএব, বাস্তবতা ও অলৌকিকতার সংমিশ্রণে ‘পদ্মাবতী’ একটি চমৎকার কাব্য।
দুটি খণ্ডে বিভক্ত এ কাব্যের প্রথম দেখা যায়, সিংহলের রাজা গন্ধর্ব সেন ও রানী চম্পাবতী। তাদের পরমাসুন্দরী কন্যা পদ্মাবতী। শাস্ত্রজ্ঞ ও দূরদর্শী শুকপাখি তাদের সঙ্গী। নাম হীরামণি। হীরামণি সদ্যযৌবনা পদ্মাবতীর সঙ্গে অতি রসালাপ করায় গান্ধর্ব ক্রুদ্ধ হয়।
চিতােরের রাজা চিত্রসেনের মৃত্যুর পর রাজকুমার রত্নসেন সিংহাসনারােহণ করে। রত্নসেন পাখির খোঁজ পায় এবং শুকের মুখে পদ্মাবতীর সব সংবাদ জানে। নাগমতীর আশঙ্কা অনুসারেই রত্নসেন সিংহল যাত্রা করে এবং শুকপাখির পরামর্শ মতাে যােগী বেশে সেখানে পূজার ছলে মন্দিরে অপরূপা পদ্মাবতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং নানা ঘটনার পর যােগ্যপাত্র বিবেচনায় রত্নসেনের হাতে গান্ধর্ব সেন নিজকন্যা পদ্মাবতীকে সমর্পণ করে। রত্নসেন- পদ্মাবতীর মিলনের দীর্ঘ বন্ধুর পথ অতিক্রমকালে শুকপাখি হীরামণি তাদের সঙ্গে ছিল। এ মিলন সম্পন্ন হলে পাখি সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়। পদ্মাবতীর প্রথম খণ্ড এ পর্যন্ত।
অপরদিকে দ্বিতীয় খণ্ডে দেখা যায়, দীর্ঘদিন বিরহে থেকে এক পাখি পাঠায় রত্নসেনের প্রথম স্ত্রী নাগমতী। রত্নসেন পাখির কাছে পূর্বাপর শুনে দ্বিতীয় স্ত্রী পদ্মাবতীকে নিজরাজ্য চিতােরে নিয়ে আসে। তার রাজ্যের রাজপণ্ডিত রাঘবচেতন চাতুরির আশ্রয় নিলে রাঘবকে চাকুরিচ্যুত করে রত্নসেন। রাঘব প্রতিশােধ নেবার আশায় দিল্লির বাদশাহ আলাউদ্দিনকে গিয়ে পদ্মাবতীর রূপের বিবরণ দিলে আলাউদ্দিন চিতাের আক্রমণ করে।
বারাে বছর যুদ্ধ চলে। রত্নসেন বন্দি হলেও তার দুই সহচরের কৌশলে মুক্ত হয়। এদিকে আর এক রাজা দেবপাল পদ্মাবতীকে পেতে চায়। তার সঙ্গে রত্নসেনের যুদ্ধে দেবপাল নিহত ও রত্নসেন আহত হন। আহত রত্নসেন সাত দিন পর মারা যায়। এই শােকে তার দুই স্ত্রী নাগমতী ও পদ্মাবতীও চিতায় সহমরণত্ব বরণ করে।
এ সংবাদ আলাউদ্দিন জানত না। সে পদ্মাবতীকে লাভ করার জন্য আবার চিতাের আক্রমণ করতে এসে পদ্মাবতীর চিতাভস্ম দেখে। এখানেই কাব্যের শেষ।
এ কাব্যের মাধ্যমে আলাওলের কবি সত্তার একটি সামাজিক পরিচয় পাওয়া যায়। তার কবিসত্তার ধর্ম ছিল মানবিক মূল্যবােধের প্রতিষ্ঠা করা। তার ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে এ দিকটি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
‘পদ্মাবতী’ কাব্যটি প্রেমমূলক ঐতিহাসিক কাব্য। তবে প্রেমই এখানে মুখ্য, ইতিহাস গৌণ। দুটি ভিন্ন অংশে বিভক্ত কাহিনি নিয়ে পদ্মাবতীর কাহিনি গড়ে উঠেছে।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup