তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী। তার রচিত বেশ কয়েকটি উপন্যাস বাংলা চিরায়ত কথাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তার হাঁসুলীবাঁকের উপকথা” (১৯৪৭) উপন্যাসে বীরভূমের কাহার সম্প্রদায়ের জীবন, তাদের সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস, আচার-আচরণ, লােককথা আন্তরিকতার সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে।
কাহারেরা দেবতার পূজা দিয়েছে ভক্তিমন্ত হয়ে, নানা উপকরণে সজ্জিত করেছে বাবা ঠাকুরের থান। এ-সব তারাশঙ্করের চোখে দেখা বলেই কাহারদের সংস্কৃতিজীবন তথা নৃত্য-গীত, পূজা-পার্বণের চমৎকার বর্ণনা তিনি উপস্থাপন করেছেন হাঁসুলীবাঁকের উপকথা উপন্যাসে।
চৈত্র সংক্রান্তিতে বার্ষিক গাজন উৎসবের মাধ্যমে কাহাররা তাদের প্রধান দেবতা কালারুদ্রের পুজো দেয়। এতে প্রধান ভক্ত চড়কের পাটার গজালের ডগায় শয়ন করে। সে আগুনের ফুলের ওপর নাচে। চড়কের পাটায় চড়ে কাহার পাড়া ঘুরে আবার এক বছরের জন্য বাবা যান জল-শয়ানে কালিদহের মাঝে। হাড়ি, ডােম, বাউরি, কাহার নিচু জাতের যে কেউ কালারুদ্রের ভক্ত হতে পারে। কাহার প্রধান বনওয়ারী গাজনের পাটায় শুয়ে কাহারকুলের মঙ্গল কামনা করে। নানা বর্ণিল সাজে এই পুজো হয়। সদগােপ মহাশয়রাও এই গাজনে শামিল হন।
একদিকে কাহার সম্প্রদায়ের আত্মবিরােধ, পরিবর্তন ও বিলুপ্তি যেমন কাহিনির একটি প্রধান ধারা, আর একটি ধারা হলাে প্রাচীন সমাজের সঙ্গে নতুন পরিবর্তমান জগতের সংঘাত।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় হাঁসুলীর্বাকের উপকথা উপন্যাসে একটি বিশিষ্ট কৌম জনগােষ্ঠীর ভাষা প্রয়ােগে দক্ষতা ও বাস্তবানুগত্যের পরিচয় দিয়েছেন সর্বত্র। উপন্যাসে তিনি কাহার সম্প্রদায়ের মুখের কথা ব্যবহার করেছেন বাস্তবানুগ করেই।
সর্বজ্ঞ ঔপন্যাসিকের ভাষ্যে মান্য চলতি ভাষার ব্যবহার এই উপন্যাসে সাবলীল রূপ লাভ করেছে। এতে ব্যবহৃত পাত্রপাত্রীর মুখের ভাষা বীরভূমের রাঢ় অঞ্চলেরই বিশেষায়িত উপভাষা। উজ্জ্বল এর বিচিত্র চরিত্রগুলি। সেই সঙ্গে আছে এক আদিম মানবিক সংরাগ।
কাহারকৌমের অবিমিশ্র বাস্তব অর্থাৎ আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের স্বরূপ তথা ওই আদিমগােষ্ঠীর টোটেম, প্রত্নপ্রতিমা এবং উপকথা-উদ্ভূত বিশ্বাস ও জীবনসত্য হাঁসুলীর্বাকের উপকথায় জীবন্ময় হয়ে উঠেছে।
Be Connected with us: Facebook Page Or Join to Our Facebook Goup